
শ্রীচৈতন্য কে ? গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম কি ? এটা আলোচ্য বিষয় কেন ? এসব জেনে আমাদের কি লাভ ?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার জন্যই বর্তমান নিবন্ধটির অবতারণা।
শ্রীচৈতন্য একজন বাঙালি। আদিনিবাস বর্তমান বাংলাদেশে। জন্মেছেন মধ্যযুগে বর্তমান পশ্চিম বঙ্গের নদীয়া জেলার নবদ্বীপে। আর্যাবর্তেও বৈদিক ধর্মের চতুর্বর্ণ প্রথার (Caste System) নিষ্পেষণ এবং বিদেশি শাসকদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে তিনি এক অহিংস আধ্যাত্মিক আন্দোলনের সঞ্চার করেন, যার নাম গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম। ধর্মগুরু আর রাজ-শাসনের অত্যাচারে জর্জরিত বাংলার দিশেহারা অন্ত্যবর্ণ সাধারণ জনগণকে তিনি মুক্তির পথ দেখিয়েছেন, ঐক্যবদ্ধ করেছেন এবং নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহস যুগিয়েছেন এই আন্দোলনের মাধ্যমে। তাঁর আবির্ভাবে এবং কর্মতৎপরতায় গণমানুষের উদ্যোগে তৎকালীন সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আসে। মানুষ হিসেবে জন্মলাভ করে স্বাভাবিক মনুষ্য জীবন-যাপন করা সম্ভব হয়। ধর্মের জন্য মানুষ না হয়ে মানুষের জন্য ধর্ম- এই বোধ সৃষ্টি হয়। বাংলা ভাষায় বৈষ্ণব সাহিত্যের নতুন ধারা সৃষ্টি হয়, যা গণমানুষকে জাগাতে সাহায্য করে। বাংলার সংস্কৃতিতে উদারনৈতিকতা, সহনশীলতা ও সাহসিকতার রূপান্তর ঘটে। মধ্যযুগে বাঙালি সভ্যতায় নতুন চেতনা সূচিত হয় যাকে ইতিহাসবেত্তারা বলেন বাঙালি জাতির প্রথম জাগরণ এবং উনিশ শতকে বাংলায় দ্বিতীয় জাগরণের পথিকৃৎ। তার সিঁড়ি বেয়ে বহু উত্থান পতনের ধাপ পেরিয়ে আমরা ১৯৭১ খৃস্টাব্দে বাঙালি সভ্যতা, বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতিসত্তার ¯বীকৃতি তথা জাতিরাষ্ট্র বা স্বাধীন সার্বভৌম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ অর্জন করেছি।
এখন পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম সভ্য জাতি হিসেবে অন্যান্য সভ্যতার মতো আমাদেরকেও সামনে এগিয়ে যেতে হবে। অতীত আমাদের ভিত্তি, বর্তমান আমাদের পথ চলা এবং ভবিষ্যত আমাদের লক্ষ্য। তাই অতীতের চাপা পড়া গৌরবজনক দিকগুলো আমাদের সামনে তুলে আনতে হবে। এমনি এক গৌরবজনক ব্যক্তিত্ব ও অধ্যায় শ্রীচৈতন্য ও তাঁর গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম । তাঁকে না জানলেও বা ভুল জানলেও তিনি জাগরণের দিশারী হয়ে আমাদের অস্তিত্বে মিশে আছেন। তাঁর গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম জনপ্রিয় না হলেও সবার অবচেতন মনে ও মগজে প্রভাব বিস্তার করে আছে।
যারা শ্রীচৈতন্যকে বা বাঙালির নিজের অতীতকে জানতে ইচ্ছুক, তাঁদের উদ্দেশ্যে এই নিবন্ধটি উৎসর্গিত হলো।
শ্রীচৈতন্য (১৪৮৬–১৫৩৪ খৃ.)
‘চৈতন্য চরিতামৃত’ অনুসারে শ্রী চৈতন্যর আবির্ভাব ঘটে ৮৯২ বঙ্গাব্দের ৫ই ফাল্গুন পূর্ণিমায় চন্দ্রগ্রহণের রাতে। সেই মোতাবেক ১৪৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ই ফেব্রুয়ারী। বাবা জগন্নাথ মিশ্র ও মা শচীদেবীর দ্বিতীয় পুত্রসন্তান। বাবা-মা নাম রাখেন বিশ্বম্ভর মিশ্র; ডাক নাম ছিল গোরা, গৌরাঙ্গ ও নিমাই; সন্ন্যাস ব্রত গ্রহণ করার পর নাম হয় শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য। গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রধান ব্যক্তিত্ব হিসেবে ভক্তরা বলেন মহাপ্রভূ। সব মিলিয়ে নাম তাঁর শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভূ। জন্মস্থান পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার নবদ্বীপে। তাদের আদি পৈতৃক নিবাস বাংলাদেশের সিলেট জেলার ঢাকা-দক্ষিণ গ্রাম। পিতা জগন্নাথ মিশ্র বিদ্যার্জনের জন্য নবদ্বীপে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। বিষ্ণু পণ্ডিত নিমাইকে শিক্ষার হাতেখড়ি দেন। পরে গঙ্গাদাস পণ্ডিতের চতুষ্পাঠীতে ব্যাকরণ, অভিধান, কাব্য, দর্শন ও অলঙ্কার শাস্ত্র শেখেন। এর পর মুকুন্দ সঞ্জয়ের চণ্ডীমণ্ডপে চতুষ্পাঠী খুলে নিজেই শেখাতে শুরু করেন। তখন থেকে মেধাবী ও পন্ডিত হিসাবে তাঁর খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সেকালের রেওয়াজ অনুযায়ী অধ্যাপনার জন্য, মতান্তরে আর্থিক সঙ্কটে পড়ে, পিতৃপুরুষের ভিটাবাড়ি সিলেটে আসেন। তার আগে ১৫০২খৃ. সনে বিয়ে করেন। সিলেটে আসার পর সাপের কামড়ে স্ত্রী লক্ষ্মীপ্রিয়ার মৃত্যু ঘটে। সিলেট থেকে নবদ্বীপে ফিরে গিয়ে স্ত্রীর মৃতু্যু সংবাদ শুনে ব্যথিত হয়ে ভক্তি অনুশীলনে মন দেন। তাঁর মা দ্বিতীয় বার বিয়ে করালেও সংসার জীবনে তিনি আর ফিরে আসেননি। ইতোমধ্যে তাঁর শ্রীকৃষ্ণ নাম কীর্তন ও সঙ্গীত সাধনার পাশাপাশি জ্ঞানার্জন ও সংস্কৃতভাষার প্রতি প্রবল অনুরাগ সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ১৫০৮ খৃস্টাব্দে পিতার মৃত্যুর পর শ্রাদ্ধানুষ্ঠান সম্পন্ন করার জন্য গয়ায় তীর্থ ভ্রমণে গিয়ে সন্ন্যাসী ঈশ্বর পুরীর শীষ্যত্ব গ্রহণ করেন। গুরুর কাছে গোপাল কৃষ্ণ মন্ত্রে দীক্ষা লাভ করে ফিরে আসেন দেশে। তখন থেকে ভক্তিবাদের প্রতি তাঁর প্রবল ঝোঁক পরিলক্ষিত হয়। তিনি পণ্ডিতি ছেড়ে দিয়ে কৃষ্ণ সংকীর্তন দল গঠন করেন। বৈষ্ণবদের তখনকার স্থানীয় গুরু অদ্বৈত আচার্য, নিত্যানন্দ, যবন হরিদাস, শ্রীবাস পণ্ডিত, মুকুন্দ দত্ত প্রমুখ বৈষ্ণব ভক্ত তাঁর দলে যোগ দেন। তারা শ্রী চৈতন্যকে ব্রাহ্মণ পণ্ডিত থেকে কৃষ্ণভক্তে রূপান্তরিত হতে দেখে মুগ্ধ হন এবং অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তাঁকে নদীয়ার বৈষ্ণবদের নেতা নির্বাচিত করেন।
গুরু কেশব ভারতীর কাছে সন্ন্যাসব্রতের দীক্ষা ও শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য নাম পেয়ে তিনি ১৫১০ খৃস্টাব্দে বাংলাদেশের বাইরে তীর্থস্থান পরিভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন এবং কাটোয়া, শান্তিপুর, পুরী, দাক্ষিণাত্য, কাশী, প্রয়াগ, মথুরা, ঝাড়খণ্ড, রামেশ্বর, কেরল, মহারাষ্ট্র ও বৃন্দাবনসহ ভারতবর্ষের বিভিন্ন তীর্থস্থানে বহুবছর কৃষ্ণ নাম জপ প্রচার করেন। জীবনের শেষ আঠরো বছর, মতান্তরে চব্বিশ বছর, কাটান উড়িষ্যার পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে। উড়িষ্যার সুর্য্যবংশীয় হিন্দু রাজা প্রতাপরুদ্র ভক্তরূপে তাঁর সংকীর্তন দলে যোগ দেন এবং তাঁর ধর্মের প্রচার ও প্রসারে ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা করেন। এই সময় শ্রী চৈতন্যের ঈশ্বরপ্রেম ও ভক্তিযোগের প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। ১৫৩৩ খৃস্টাব্দের ২৯শে জুন (আষাঢ় মাসের কোন একদিন) ৪৮ বছর বয়সে পুরীতেই তিনি লোকান্তরিত হন।
গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম
মধ্যযুগে বৃহত্তর বাংলাদেশ বা গৌড় থেকে বাঙালি শ্রীচৈতন্য যে ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন, তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নরূপ:
ক। গৌড়। গৌড় মানে বৃহত্তর বাংলাদেশ। ১৫৭৬ খৃষ্টাব্দে সম্রাট আকবর কর্তৃক দখল করার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনৈতিক নাম ছিল গৌড়। আকবরের আমলে এর নাম হয় ‘বঙ্গাল’ মুল্ক বা সুবে বাংলা। প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন সময় গৌড়ের সীমানায় কম-বেশি পরিবর্তন দেখা যায়: কখনো বর্ধমানের উত্তরে ও পদ্মানদীর দক্ষিণের অঞ্চল, কখনো মালদহ-মুর্শিদাবাদ অঞ্চল, কখনো মধ্য ও দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলা ও উড়িষ্যার কিছু অংশ এবং তার সাথে যুক্ত হয় মগধ বা বিহারের গয়া ও পাটনা, কান্যকুব্জ (কনৌজ), কামরূপ (আসাম), বিহার ও উত্তরপ্রদেশ। এর রাজধানী কখনো ছিল চম্পানগর (বিহারে অবস্থিত) কখনো কর্ণসুবর্ণ (মুশির্দাবাদ) কখনো লক্ষ্মণাবতী (মালদহ)। অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশ, পশ্চিম বঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম, ঝাড়খন্ড, মনিপুর, বিহার, উড়িষ্যা ও উত্তর প্রদেশ এবং নেপাল-ভুটান-সিকিম নিয়ে ছিল গৌড় বা বৃহত্তর বাংলাদেশের মোটামুটি সীমানা ।
খ। বৈষ্ণব ধর্ম। এই উপ-মহাদেশে ধর্মীয় বিবর্তনের ধারাবাহিকতার এক পর্যায়ে মধ্যযুগে গৌড়ে বা তখনকার বাংলাদেশে শ্রীচৈতন্যের বৈষ্ণব ধর্মের আবির্ভাব ঘটে। তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নরূপ:
(১) উৎস। আমরা নিশ্চয়ই জানি বৈদিক আর্য ধর্ম বা পৌরাণিক হিন্দু ধর্ম বা বেদ অনুসারে ঈশ্বর এক হলেও দেব-দেবী অনেক। তারা প্রত্যেকেই একেকটি প্রাকৃতিক ঘটনা বা কাজের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত। তাদের মধ্যে প্রধান প্রধান দেবগণ হলেন ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর বা শিব, গণেশ ও সূর্য আর দেবীগণ হলেন কালী, দুর্গা, লক্ষী ও সরস্বতী। ব্রহ্মা সৃষ্টি করেন, বিষ্ণু লালন-পালন করেন আর শিব ধ্বংস করেন। এভাবেই বারবার জগত সৃষ্টি ও ধ্বংস চক্রে আবদ্ধ। এই ভাঙ্গা-গড়ার জাঁতাকলে পড়ে মনুষ্যকুলকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য দেব-দেবীর উপাসনা না করে উপায় কি। তাই ‘পুরাণ’ শাস্ত্র আনুযায়ী প্রধানত পাঁচ দেবতাকেই বেশি উপাসনা করতে হয়। এই উপ-মহাদেশের উপাসকরা তাই আদিকাল থেকে গাণপত্য, সৌর, শৈব, শাক্ত, ও বৈষ্ণব সম্প্রদায়ে বিভক্ত। যারা গণেশের পূজা করে তারা গাণপত্য, যারা সূর্য দেবতার পূজা করে তারা সৌর, যারা শিবের পূজা করে তারা শৈব, যারা দূর্গা/কালির পূজা করে তারা শাক্ত আর যারা বিষ্ণুর পূজা করে তারা বৈষ্ণব। এভাবেই আর্যাবর্তের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ যার যার ইচ্ছা ও সুবিধামতো বিভিন্ন পূজারী সম্প্রদায়ে বিভক্ত। তাদের উপাসনার দার্শনিক ভিত্তিও ভিন্ন ভিন্ন। তবে আপেক্ষিক গুরুত্বের দিক থেকে ভক্তিকেন্দ্রিক সম্প্রদায়গুলির মধ্যে বৈষ্ণব সম্প্র্রদায়ের স্থান সর্বোচ্চ এবং সর্বজনবিদিত।
(২) বৈষ্ণব সম্প্র্রদায়। বিষ্ণুর পূজারীদের দার্শনিক ভিত্তি প্রধানত ভাগবত গীতা এবং ভগবত পুরাণসহ ঈষোপনিষদ, গোপাল তাপানি উপনিষদ ও কলি সন্তরণ উপনিষদ। খৃষ্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে বৈষ্ণব ধর্মের যাত্রা শুরু হয়। তবে প্রচার ও প্রসার লাভ করে বহু পরে। প্রথমে রামানুজ (১০১৭-১১৩৭ খৃ.) ভারতের দাক্ষিণাত্যে, এরপর মাধবাচার্য (১২৩৮-১৩১৭ খৃ.) কর্ণাটকে এবং রামানন্দ (১৪০০-১৪৭৬ খৃ.) বারাণসীতে, এরপর শ্রীচৈতন্য বাংলায় এবং শ্রীমন্ত শংকর দেব (১৪৪৯-১৫৬৮ খৃ.) আসামে এই ধর্মমত প্রচার শুরু করেন। এদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্র্য রয়েছে। এর ক্রমবিবর্তনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস এরকম: রামানুজের মতানুযায়ী নারায়ণ (ভগবান) সর্বেসর্বা এবং মহাবিশ্বের নিয়ন্ত্রক। জীব তার পূজারী। ব্যক্তি জীবের চিত্ত বা আত্মা চীরস্থায়ী, দেহ ক্ষণস্থায়ী। আত্মা চিরসত্য হলেও নারায়ণের নিয়ন্ত্রণাধীন। জীবকে নারায়ণের কাছে পুরোপুরি আত্মসমর্পন করতে হয়। আত্মার অস্তিত্ব ভগবানের উপর নির্ভরশীল। রামানুজের আবির্ভাব তামিলনাড়–র পেরামবুদুর গ্রামে। রামানুজের পর মাধবাচার্য ভক্তি আন্দোলন প্রবর্তন করেন। তিনি দ্বৈতবাদী দর্শনের প্রবক্তাও। তিনি ভগবান ও ব্যক্তির আত্মার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য নির্দেশ করেন। তাঁর দ্বৈতবাদ কর্ণাটকে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। মাধবাচার্যের আবির্ভাব হয় ভারতের কর্ণাটক জেলার উদুপি তালুকের পজক গ্রামে। মাধবাচার্যের পর ভক্তি আন্দোলনকে ব্যাপক সামাজিক সংস্কার আন্দোলনে নতুন রূপ দেন স্বামী রামানন্দ। তাঁর শিক্ষাÑ রাম সর্বশক্তিমান ও সর্বশ্রেষ্ঠ প্রভূ। তাকে ভালোবাসা এবং তার নাম বার বার স্মরণ করাই সৃষ্ট জীবের কাজ। রামানন্দের কাছে সকল বর্ণের মানুষের অবাধ ও সমান অধিকার ছিল। তাঁর অনুসারীরা দ্বারকা ও ব্রজকেন্দ্রিক ভক্তি ধারায় বিভক্ত। তিনি হিন্দি ভাষার রূপকার হিসেবেও খ্যাত। তাঁর বিখ্যাত বারো ভক্তের মধ্যে ভবানন্দ, কবির, রবিদাস ও তুলসিদাসও ছিলেন। বারানসীতেই তাঁর আবির্ভাব ও জীবন অতিবাহিত হয়।
দ্বৈতবাদের বিপরীতে শংকরাচার্যের (৭৮৮- ৮২০খৃ.) অদ্বৈত দর্শন: “ব্রহ্ম সত্য, জগত-সংসার মিথ্যা, ব্যক্তিগত জীবাত্মা আর ব্রহ্ম এক ও অভিন্ন”-এর অনুসারী রাজস্থান ও গুজরাটে বৈষ্ণববাদের প্রবর্তক বল্লভ আচার্য (১৪৭৯-১৫৩১ খৃ.) শুদ্ধ অদ্বৈতবাদের প্রবক্তা হিসেবে খ্যাত। তাঁর মতে ভগবান সর্বেসর্বা। একমাত্র তাঁরই দয়ায় আত্মার মুক্তি ও মোক্ষলাভ ঘটে। কৃষ্ণ তার অবতার। ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবের ‘লোক’ থেকে কৃষ্ণের লোক অনেক উর্ধে। শংকরাচার্যের আবির্ভাব কেরালার ইর্নাকুলাম জেলার কালাদি গ্রামে এবং বল্লাভাচার্যের আবির্ভাব বর্তমান ছত্তিশগড়ের রায়পুর জেলার চম্পারণে।
রামানুজের নারায়ণ, মাধবাচার্যের ভক্তি, রামানন্দের রাম, শংকরাচার্যের সন্ন্যাসব্রতের সঙ্গে বাংলাদেশের শ্রীচৈতন্য ষোল শতকে অদ্বৈত ও দ্বৈতবাদকে একসূত্রবদ্ধ করে যুক্ত করেন ভক্তিমন্ত্রের মাধ্যমে একেশ্বরোপাসনা, যার নাম ভক্তিবাদ। তাঁর মতে কৃষ্ণ ভগবানের রূপ এবং বিষ্ণুর উৎস। আর কৃষ্ণের সঙ্গী রাধাও কালী, দুর্গা, লক্ষী, সরস্বতী ও সীতাসহ অন্যান্য দেবীগণের শক্তির আধার। তিনি রাধা ও কৃষ্ণের জাগতিক প্রেমকে ভগবানের প্রতি ভক্তি ও প্রার্থনায় গুণগত রূপ দান করেন। ভক্তিবাদের মূল মন্ত্র রাধা-কৃষ্ণের প্রেম বা ভক্তি স্বয়ং ভগবানের রূপ। তাঁর মন্ত্রের নাম হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র:“হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে, হরে রাম হরে রাম, রাম রাম হরে হরে” যা কীর্তন যা সুর করে নেচে নেচে গাওয়া হয় । ভক্ত ও অনুসারিদের জন্য শ্রীচৈতন্য শিক্ষামূলক নির্দেশনা শিক্ষাষ্টক প্রবর্তন করেন। মধ্যযুগে বাংলাদেশ বা গৌড় থেকে এর যাত্রা শুরু হয় বিধায় এর নাম গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মীয় আন্দোলন। এছাড়া চৈতন্য বৈষ্ণববাদ এবং হরেকৃষ্ণ ধর্ম হিসাবেও পরিচিত। বাংলাপিডিয়ার মতে, ‘এর সঙ্গে সূফী ধর্মমতের আশেক-মাশুক তত্ত্ব, নাম-মাহাত্ম্য, জিকির এবং সামা নাচ-গানের মিল দেখা যায়।’
একই সময়ে আসামে শ্রীমন্ত শংকর দেব (১৪৪৯-১৫৬৮ খৃ.) ‘এক শরণ ধর্ম’ প্রবর্তন করেন। এর অর্থ ঈশ্বর এক এবং যে কোন নামে তাকে ডাকা যায়। তাঁর ‘দাস্য ভক্তি’ বা ঈশ্বরানুগত্যের নামকির্তন চর্চায় হরি, রাম, নারায়ন ও কৃষ্ণ আছে কিন্তু রাধা নেই। তিনি আসামে প্রচুর ‘নামঘর’ বা সন্যাসী মঠ প্রতিষ্ঠা করেন। এই ধারা আসামে ব্যাপক প্রচলিত। তিনি আসামের নগাঁও জেলার আলিপুখুরি গ্রামে শিরমণি বার ভুঁঞা পরিবারে আবির্ভূত হন।